কুরআন হাদীস কারা পুড়েছিল ?সব ভুলে গেলেন ? এফ শাহজাহান
লিখেছেন লিখেছেন এফ শাহজাহান ০৫ জুন, ২০১৩, ১০:৪৫:১৬ সকাল
মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে আপারেশন ফ্যাশআউটের একমাস পুর্তি হচ্ছে আজ। গত ৫ মে বাংলাদেশের সংবিধানে ‘মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনস্থাপন ‘নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি’ সহ ১৩ দফা দাবিতে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ তৎপরবর্তী ঢাকার শাপলা চত্বরে সমাবেশকে কেন্দ্র করে বায়তুল মোকাররম মসজিদের আশে পাশের ফুটপাতের দোকানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও কোরআন-হাদীস কারা পুড়েছিল তা নিয়ে দেশে অনেক বিতর্ক হয়েছে। সরকার ও ১৪ দলীয় মহাজোটের প থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে হেফাজত, জামায়াত, বিএনপি ও খোদ ১৮ দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দায়ি করেছেন। আবার হেফাজতে ইসলাম ও সরকার বিরোধীরা সরকারকে দায়ি করে বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছিলেন ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা দেবাশিশের নেতৃত্বে এই ঘটনা ঘটেছে।’ যার কারণে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলাও হয়েছে। একমাস না যেতেই এই জাতি ইতিহাসের ভয়ংকর সেই রাতের কথা ভুলতে বসেছে। কিন্ত এই নিয়ে যেসব প্রশ্ন তৈরী হয়েছিল তার একটারও উত্তর মিলেনি কোথাও।
প্রথম প্রশ্ন,তাহলে ঐদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিন গেইটের সব দোকান লুটপাট,অগ্নিসংযোগ করে বিপুল পরিমান কোরআন-হাদীস কারা পুড়েছিল ? এর জবাব কোথায় আছে ?
আরেকটি প্রশ্ন,সরকারের অভিযোগ অনুযায়ী এবং প্রিপেইড মিডিয়াগুলোর প্রচারনা অনুযায়ী সে গুলো যদি হেফাজতের লোকজনই পুড়িয়ে ফেলতো তাহলে সরকার সুকৌশলে সেই ইস্যুটি চেপে যাচ্ছে কেন? সরকার কী এতই দয়াবান হয়ে গেলো যে যারা কুরআন হাদিস পুড়ে ফেললো আর লুটপাট করলো সরকারের সেই হেফাজতী দুষমনদের সরকার ক্ষমা করে দিয়েছে?
শেষ প্রশ্ন,সেদিন কী এমন একজনও প্রত্যক্ষদর্শীও ছিলেন না যিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন যে কার নেতৃত্বে কারা সেদিন কুরআন হাদিস পুড়েছিল ?
আমি এই শেষ প্রশ্নের উত্তরটাই দিচ্ছি।
ঐ ঘটনার এমন একজন আই উইটনেস আছেন যিনি রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ জাতীয় ইমাম। রাষ্ট্র কর্তৃক তিনি সারাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইমামের মর্যাদা পেয়েছেন। অর্তাৎ জাতীয় ইমাম প্রতিযোগিকায় তিনি সারাদেশে প্রথম হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট পদক পেয়েছেন । তিনি সেদিন নিজের চোখে কুরআন হাদিস পুড়ানো দেখেছেন। তার পরিচয় প্রকাশ পেলে জীবন এবং রাষ্ট্রীয় পদক হারানোর আশংকা থাকায় সুদুর ঢাকা থেকে তিনি আমার কাছে এসেছিলেন সেই ঘটনাটি বলার জন্য । আমি আসলে তার কাছ থেকে শুনে এই লেখাটি তৈরী করেছি। তিনি যা বলেছেন, ঠিক সেভাবেই বর্নিত হচ্ছে।
তিনি বলেছেন,ঘটনাক্রমে আমি নিজেই ঐ সময়ের বায়তুল মোকাররম মসজিদের দণি গেট এলাকার একজন প্রত্যদর্শী হতে পেরেছিলাম। ৫ মে’র কয়েকদিন আগে বিশেষ একটা কাজে আমার ১৩ বছরের একজন ছেলেকে সাথে নিয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম। ছেলেকে ঢাকা ঘুরে দেখাবার উদ্দেশ্যে ঐ দিন বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দণি গেটে পৌঁছি। ুধার ভাব হওয়ায় সেখানে ফুটপাতের দোকানে হালকা নাস্তা-পানি খেয়ে বায়তুল মোকাররমের দেিণর রাস্তা দিয়ে পশ্চিমে সচিবালয়ের দিকে যেতে থাকি। পল্টনের জিরো পয়েন্ট থেকে গোলাপ শাহ মাজারের দিকে আসা রাস্তার মাঝখানে চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতেই দেখলাম হেফাজতের হাজার হাজার কর্মীরা আসে পাশের বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে মিছিল করতে করতে ঢাকার শাপলা চত্বরের দিকে যাচ্ছে। তখন দুপুর আনুমানিক ১২ টা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঐ এলাকার প্রায় হাজার খানেক পুলিশ তখন হঠাৎ করেই প্রথমে ফাঁকা গুলি ও পরে সরাসরি গুলি করতে লাগল। মূহুর্তের মধ্যেই তখন চারিদিকে চরম আতংক ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ পথচারিরা ও হেফাজত কর্মীরা দিগি¦দিক দৌড়াদৌড়ি ও ছুটাছুটি করতে লাগল। মূহুর্তের মধ্যেই এলাকার সব দোকান পাট বন্ধ হয়ে গেল। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে গেলাম। চারিদিকে পুলিশ আর পুলিশ। পল্টনের দিকে ল করে দেখলাম বিপুল সংখ্যক হেফাজত কর্মীরা গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছে। দৌড়াদোড়ি করে আসা পথচারিরা বলছে ওখানে ২০/২২ জন মারা গেছে, শত শত আহত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে আবার বায়তুল মোকাররমের দণি দিকের ফুটপাতে অতঃপর অবস্থার নাজুকতায় একটি হোটেলে আশ্রয় নিলাম। গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ আর টিয়ারশেলের কারণে পুরো এলাকা তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঐ হোটেলের ভিতরেও টিয়ারশেলের ঝাল আমাদের চোখে লাগল। আমার ছেলে পকেট থেকে রুমাল বের করে গ্যাসের পানিতে ভিজে নিয়ে চোখ মুছল।
একটু পরেই দেখলাম হাজার হাজার হেফাজত কর্মীরা বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম রাস্তায় দণি মুখি হয়ে দেিণর রাস্তা পর্যন্ত আবার চলে এসেছে। কে যেন বলল ঢাকা অবরোধের ৬টি পয়েন্টের ল ল হেফাজত কর্মীরা শাপলা চত্বর মুখি আগমনের ফলে পুরো ঢাকা লোকে লোকারণ্য। হয়ত ওদিকে জায়গা না হওয়ার কারণে এদিকে আসতেছে। এদিকে পুলিশরাও বায়তুল মোকাররমের দণি রাস্তায় উত্তরমুখি হয়ে মুখোমুখি অবস্থায় ছিল। মাত্র কয়েক মূর্হুত পরেই শুরু হল হাজার হাজার রাউন্ড গুলি। হেফাজতের হাজার হাজার কর্মীরা মূহুর্তের মধ্যেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। ধ্বনিত হল ‘আল্লাহ্ আকবার।’ দেখা গেল সামনের সারির শত শত হেফাজত কর্মীদের শরীর বিদ্ধ করেছে পুলিশের ছিঁটাগুলি। লালে লাল হয়েছে তাদের পরণের কাপড়। অস্থির হয়ে কাতরাচ্ছে আর চিৎকার করছে তারা। তখন বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম রাস্তার উত্তর দিকের পূর্ব পার্শ্বে বিকট শব্দ ও আগুন জ্বলে উঠল। কেউ কেউ বলল হেফাজতিরা বোধ হয় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আবার একজন দৌড়ে এসে বলল পুলিশের গুলিতে একটি মোটর সাইকেলে আগুন লেগেছে। দৃশ্যটা ছিল এক অভূতপূর্ব ও অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। আশে পাশের লোকেরা বলে উঠল ‘এ যে ৭১ এর যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা।’ পুলিশের মূহুর্মূহু গুলিতে আহত হেফাজত কর্মীরা রাস্তায় শুয়ে গড়িয়ে গড়িয়েই পিছু হটতে লাগল। মার্কেটের গলিতে আমার পাশে জড়ো হয়ে থাকা লোকদের বেশ কিছু সংখ্যক হাত নেড়ে নেড়ে হেফাজত কর্মীদের বীরত্বের জন্য অভিনন্দন জানাল।
এমন অবস্থায় মিডিয়া কর্মীরা কখনও ঘটনার চিত্র ধারণ করছেন, আবার কখনও করছেন না। পুলিশের বর্বরতার অনেক দৃশ্য তারা ধরছেন না। অথচ হেফাজত কর্মীরা যখন বাধ্য হয়ে পুলিশকে আক্রমন করছে তখন তারা সেই চিত্র ধারণ করার জন্য হুমরি খেয়ে পড়ছেন। আমার পার্শ্বের একজন লোক সাংবাদিকদের বললেন ‘ভাই পুলিশের বর্বরতার ছুবি তুলছেন না কেন ?’ তখন একজন সাংবাদিক হাত জোড় করে বললেন ‘মাফ চাই ভাই।’ লোকটি বলল ‘বুঝেছি ভাই বুঝেছি। আপনারা হলেন সরকারের দালাল। আর এই সরকার বলে আমরা জনমতকে প্রাধান্য দেই। তারা শাহাবাগের দাবি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের জন্য আইন সংশোধন করল। অথচ তার চেয়ে ১০ গুণ বেশী হেফাজতের লোক, আর তাদের দাবি মানছেনা।’
মিডিয়া কর্মীদের এই অবস্থা আর ঐ লোকের কথায় আমার চোখের পর্দায় ভেসে উঠল শাহাবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের দৃশ্য। যেখানে কোন কোন সময় ৫০ জন লোকও দেখা যায় না। তবুও দীর্ঘ দেড় মাস যাবত দেশের প্রায় সমস্ত মিডিয়া অনবরত তাদের খবর পরিবেশন করেছে। লাইভ অনুষ্ঠান দেখিয়েছে। যদিও দেশের অধিকাংশ মানুষ তাতে বিরোক্ত বোধও করেছে। পান্তরে গত ৬ এপ্রিল শাপলা চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবি সহ ১৩ দফা দাবিতে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববৃহৎ মহা সমাবেশ করল হেফাজতে ইসলাম। এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ল ল লোক নিয়ে তারা অনেক গুলো সমাবেশও করেছে। নানা কর্মসূচী পালন করেছে। আজও কয়েক ল লোকের সমাবেশ করছে। অথচ তার খবর এই সব মিডিয়া সবমিলিয়ে মাত্র ১০ মিনিটও হয়ত প্রচার করেনি। বরং তারা পপাত দুষ্ট সংবাদ প্রচার করেছে। তবে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি গণজাগরণ মঞ্চের খবর যেমন পরিবেশন করেছে। তেমনি হেফাজতের খবরও বস্তুনিষ্ঠ ভাবেই পরিবেশন করছে। যা দেশবাসি প্রত্য করছে। আমার ধারণা সাংবাদিকদের ইসলাম সম্পর্কে নন্যুতম ধারণা এবং আখিরাতের ভয় না থাকার কারণেই- সংবাদজগতের এই নীতিহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে শাহাবাগে হাজার হাজার নবজাতক ও কোলের শিশুকে নিয়ে আসা তাদের চোখে দোষণীয় না হলেও শাপলা চত্বরে মাদ্রাসা পড়–য়া ফাইভ-এইটের সমমানের ছাত্রদের নিয়ে আসা তাদের চোখে দোষণীয় মনে হয়েছে।
এদিকে আমার ছেলে বলল ‘আব্বা আমিও যুদ্ধে যাব। ইসলামের জন্য এত লোক শহীদ হচ্ছে। আমিও শহীদ হব আব্বা।’ বলেই সে কাঁদতে লাগল। ১৩ বছরের এই ছোট্ট ছেলের চোখ থেকে তখন দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ছেলের মনের ইসলামী আবেগ ও কান্না দেখে আমার মনের ভিতরও কান্না পেল। মনে পড়ল হযরত ইসমাইল (আঃ) এর কথা। তিনি ছেলে বেলায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবনকে কুরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন। এমন সন্তান পেয়ে ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহ প্রদত্ত্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করতে সম হয়েছিলেন। আমিও নিজেকে ধন্য মনে করলাম। ভাবলাম আল্লাহ এই যুগেও তুম আমাকে এমন সন্তান দান করেছো যে সন্তান হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের মত এক পিতার কাছে নিজের জীবনকে আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়েছিল। আল্লাহ তুমি আমাকেও এমন শক্তি দাও যাতে নিজের সন্তানকে তোমার দ্বীন কায়েমের জন্য শহীদ হতে দেখে চক্ষু জুড়াতে পারি। এসব অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে আমার দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর কওে পানি পড়ছিল আর আমার মনের মধ্যে তখন ব্যতিক্রম ধর্মী কিছু প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছিল। যেমন,
(১) ৭১ সালে ভিনদেশী ঘাতক পাকিস্তানীরা নির্মম ও নিষ্ঠুর ভাবে আমাদের উপর গুলি বর্ষণ করেছে। কিন্তু আজ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে শক্তি বলে দাবিদার আওয়ামী সরকারের পুলিশ বাহিনী কাদের উপর নির্মম, নিষ্ঠুর ও বর্বর ভাবে গুলি চালাচ্ছে ? তবে কি যাদের জন্য দেশের ল ল মসজিদে আজান ও নামাজ হচ্ছে, হাজার হাজার মাদ্রাসায় কোরআন-হাদীসের তালিম হচ্ছে, আর যারা সৎ চরিত্রবান ও ধার্মিক মানুষ হিসাবে সমাজে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, যাদের বুকের ভিতর হৃদয়ে খোদাই হয়ে আছে কোরআন-হাদীসের অমিয় বাণী, নিরস্ত্র সেই আলেম উলামাদের বুক কি পুলিশের বুলেটের আঘাতে তারা ঝাঁঝড়া করে দিবে? তাদেরকে রাজপথের এতবড় আন্দোলন থেকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে সমস্যার সমাধানের কোন পথই কি সরকারের কাছে ছিল না ?
(২) অতীতের ইসলাম বিরোধী নমরুদ, ফেরাউন ও আবু জাহেল সরকারের সাথে ইব্রাহিম, মুছা ও মুহাম্মদ (সাঃ) এর আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা না রাখার ব্যাপারে হক ও বাতিলের যে যুদ্ধ হয়েছিল। তবে কি হাসিনা সরকারের সাথে সেই নবী-রাসূলদের ওয়ারিশ ল ল হাফেজ-ক্বারী, ইমাম-মুয়াজ্জিন, পীর-মাশায়েখ ও আলেম-উলামার সেই ধরণের যুদ্ধ শুরু হল ? আর সেই যুদ্ধে অংশ নিয়ে কি আমার কচি মাসুম বাচ্চা শহীদ হতে চাচ্ছে ?
(৩) যারা কোরআন-হাদীস, নবী-রাসূল, ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে কটুক্তি করল, খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ কেন সেই নাস্তিক ব্লগারদের প নিল ? তবে কি তারা আল্লাহর উপর বিশ্বাসী আস্তিক নয় ?
(৪) আওয়ামীলীগরা যদি সত্যি সত্যিই আস্তিক বা বিশ্বাসী মুসলমান হবে তবে ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশের সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ‘মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’কে তারা সংবিধান থেকে কেন তুলে দিল ? আর যারা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বা ঈমান রাখেনা তারা মুসলমান হয়ই বা কি করে, কিসের ভিত্তিতে ? তবে কি তারা বংশগত ও পারিবারিক সূত্রে মুসলমান দাবিদার ? তাই যদি হয় তাহলে নূহ নবীর স্ত্রী, ছেলে কেনান, লুত নবীর স্ত্রী মুসলমান হল না কেন ?
যা হোক এমনি ধরণের অনেক প্রশ্নের ঘূর্ণিপাক থেকে মনটাকে ঘুরিয়ে নিলাম। তারপর রাস্তায় ল করলাম পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে হেফাজত কর্মীরা এক পর্যায়ে উচ্ছৃংখল ও বেপরোয়া হল। এবার তাদেরকে হাতে লাঠি সোটা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেল। ফুটপাত ধরে চলন্ত এক ব্যক্তি বলল তারা কমিউনিষ্ট পার্টির অফিসে ইটপাটকেল ছুঁড়ছে। এ অবস্থায় দেখলাম আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের তাদের দলীয় অফিস থেকে বেড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে যেখানে পারল গা ঢাকা দিল। আমি যেখানে ছিলাম সেখানেও ২৫/৩০ জন আওয়ামী নেতাকর্মী ছিল। সেখানে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসা একজন ভদ্র মহিলা তার স্বামীকে বলল বাঁচতে চাইলে পার্টি অফিসে চল। সাথে সাথে সমস্বরে প্রায় সবাই বলল ‘আরে পার্টি অফিস তো এতণে হেফাজতিরা দখল করে নিয়েছে। আজ গোটা দেশ দখল করবে তারা। বাঁচার উপায় নাই।’
কিছুণের মধ্যে আবার পুলিশের এ্যাকশন শুরু হল। পুলিশের এই ঝটিকা অভিযানে, মূহুর্মূহু গুলিতে, সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ ও টিয়ারশেলে বায়তুল মোকাররমের দণি ও পশ্চিম এলাকা, পল্টন, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গোলাপ শাহ মাজার ও গুলিস্থান এলাকা থেকে পুলিশ হেফাজত কর্মীদের হটিয়ে দিল। সে সময় এক লোমহর্ষক ও ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
এমন সময় আমার ছেলে চুপি চুপি বলল ‘আব্বা প্রসাব করব।’ আমি তখন ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা একজন টোকাইকে ফিসফিস করে বললাম বাবা টয়লেট করার জায়গা কোথায় ? সে বলল ‘আমার সাথে আসেন।’ ছেলেকে তার সাথে যেতে বললাম। পরে আমিও গেলাম। সেখানে ২ জন লোক প্রসাব করতে করতে বিতর্ক করছেন। একজন বলল ‘জামায়াত শিবির ভ্রান্ত দল। আর হেফাজতই হল আসল ইসলামী দল।’ অন্য জন যিনি একটু বয়ষ্ক লোক তিনি বললেন ‘আরে বাবা এইসব কত দল দেখলাম। যাহোক আল্লাহ সবার শ্রমকেই কবুল করবেন। তবে জামায়ত-শিবির একটি পূর্নাঙ্গ ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসাবে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে ও গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশের মতা অর্জন করে কোরআন-হাদীস বিরোধী সকল আইন-কানুন বাতিল ও কোরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে বিশ্ব মানবতার কল্যাণ সাধন করতে চায়। তাদের রয়েছে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও ল্য। স্থায়ী কর্মনীতি, কর্মসূচী ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা। রয়েছে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো যা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চলে। আর হেফাজতে ইসলাম বর্তমান সমসাময়িক পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে কিছু ইসলামী দাবি তুলে ধরেছে মাত্র।’
বিকেল আনুমানিক ৫টা। আমি বায়তুল মোকাররমের দণি রাস্তার ডিভাইডারের উপর দাঁড়িয়ে চারিদিকে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখলাম ঐ এলাকায় কোথাও হেফাজত কর্মীরা নেই। পুলিশেরা তখন গোলাপ শাহ মাজার রোড, সচিবালয় ও পল্টনের দিকে চলে গেছে। এ অবস্থায় তখন আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাহস ও মনোবল ফিরে পেয়ে তাদের পার্টি অফিস থেকে লাঠিসোটা, রামদা, চাপাতি ও অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ঐ পুরো এলাকার দখল নিল। হেফাজত সন্দেহে তারা যাকে যেখানে পেল তাকে সেখানে নির্যাতন করে রক্তাক্ত জখম করল। এমনকি আমরা দণি গেটের রাস্তার দেিণ মার্কেটের যে গলির মধ্যে ছিলাম সেখান- থেকেও একজনকে টেনে হেঁচরে নিয়ে গিয়ে লাঠি পেটা করল। আমাদের গায়ে পাঞ্জাবী থাকায় আমরাও ভীষণ ভাবে চিন্তিত হলাম। না জানি কি হয়। এমন মূহুর্তে আমার ছেলে আমাকে আস্তে আস্তে বলল ‘আব্বা আমি কি পাঞ্জাবী খুলে শার্ট পড়ব ?’ ছেলের কথায় মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। পার্শের ছোট হোটেলটি তখন পর্যন্ত খোলা ছিল। হোটেলওয়ালা আওয়ামীলীগ সমর্থক হতে পারে বলে মনে হল। তবে বেচারা আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। সেখানে আমি আমার টুপি খুললাম। দুজনেই তাড়াতাড়ি করে পাঞ্জাবী খুলে শার্ট পরলাম। তখন মনে হলো হায়রে এ কোন দেশ ? শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে আজ টুপি ও পাঞ্জাবী পরাও অপরাধ !
এরপর বায়তুল মোকাররমের দণি পশ্চিম রাস্তার রোড ব্রেকারের মত সাদা টান টান দেয়া রাস্তা পারাপারের জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলাম বায়তুল মোকাররমের দণি গেটের ভিতর এক হাতে লাঠি আরেক হাতে ইট পাটকেল মারতে মারতে প্রায় দেড়শ আওয়ামীলীগ কর্মীরা একেবারে মসজিদের ভিতর ঢুকে গেল। বায়তুল মোকাররম মসজিদে আশ্রয় নেয়া একজন হেফাজত কর্মীকে টেনে হিঁচরে গেটের বাইরে নিয়ে এসে লাঠি সোটা দিয়ে এলোপাথারী আঘাত করে মূমূর্ষু অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখল। এরপর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আরেক গ্রুপ এসে তাদের সাথে যোগ দিলে তাদের শক্তি আরো বৃদ্ধি পেলো। তারা এবার চারিদিকে মোহড়া দিতে লাগল। এরপর তারা মনে হল কারও কথায় নিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে কি যেন ভেবে আবার উত্তেজিত হয়ে বায়তুল মোকাররমের দণি ও পশ্চিমের ফুটপাতের বন্ধ দোকান গুলোতে ব্যাপক লুটপাট করতে লাগল। লুটপাটে তখন তারা মহাব্যস্ত। বাদামি শার্ট গায়ে একজন বলল ‘এই সোহেল দেবাশিশ বিশ্বাস যা বলল তাই কর। আর আগে ঐ শালার দোকানে আগুন দাও। ঐ কোরআন আলা। ঐ শালা পাকা হেফাজত।’ চারিদিকে তখনও মূহুর্মূহু গুলির শব্দ। বেলাও ডুবে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সেখান থেকে বাসায় ফেরার জন্য আমি একটা পথও খুঁজতে ছিলাম। চিন্তায় মুখ শুকে কাঠ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আর বুঝি বাসায় ফিরতে পারবনা। সংকিত অবস্থায় ইশারায় আমার ছেলেকে গলির ভিতর থেকে বাইরে আসতে বললাম। ছেলে আমার কাছে আসলে তাকে বললাম বাবা কোন দিকে তাকাতাকি করবেনা। সব সময় নিচের দিকে তাকিয়ে পথ চলবে। আমি যেদিকে নিয়ে যাব সেদিকে যাবে। ওদিকে লুটপাটের মালামাল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি ছুটাছুটি করছে লুটেরা। আমরা সামনে পশ্চিমে যাচ্ছি। একটু পরে আমি ঘাড় কাত করে পিছনে তাকালাম দেখলাম দণি রাস্তার ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে আছে ওলামালীগ নেতা মাসুম বিল্লাহ। মনে হল তার হাতে একটা বই রয়েছে। আমি তাকে আগে থেকেই চিনি। আতংক গ্রস্থ হয়ে ছেলের হাত শক্ত করে ধরে ফুটপাত দিয়ে আরও পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। এরপর গোলাপ শাহ মাজারের দিকে মোড় ঘুরে বামে তীর্যক ভাবে বায়তুল মোকাররমের দিকে আবার তাকিয়ে দেখি ফুতপাতের ঐ দোকান গুলো থেকে তখন আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরা সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মনে হল কোনও এক কোরআন আলার দোকানটাই হয়ত পুড়ছে। আরও মনে হল এ আগুন যেন ঐ কোরআনের দোকানে নয় বরং আমার বুকের ভিতরেই জ্বলছে। পরদিন টিভিতে দেখানো হল হেফাজতের কর্মীরা ঐসব দোকানপাট লুট করে আগুন দিয়ে কোরআন-হাদীস পুড়েছে। যদিও উক্ত ঘটনাটি ঘটেছে সন্ধ্যায়। কিন্তু মিডিয়া প্রচার করেছে রাতে হেফাজত কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির অভিযানের সময় হেফাজত কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পথে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।যদিও কে পুড়েছে তার ছবি তারা দেখাতে- পারেনি। খবর শুনে আমি অত্যন্ত ব্যথিত হলাম। অবাক হলাম। ভাবলাম এটা কোন ধরণের তথ্য সন্ত্রাস ও মিথ্যাচার। সত্যি কথা বলতে কি এরপর থেকে আমি আর টিভির খবর বিশ্বাস করতে পারছিনা। টিভি দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কারণ যারা কোরআন-হাদীস ও ইসলামের জন্য আন্দোলন করে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে কি করে সেই কোরআনের হাফেজেরা কোরআন-হাদীস পুড়তে পারে ? বর্ণিত ঘটনার যথেষ্ট স্যা প্রমাণ আমার কাছে আছে। যা ইতিহাসের ঐ কঠিন মূহুর্তে মোবাইলে ধারণ করতে পরেছিলাম। যদি রাতে থাকতাম তাহলে হয়ত সোনার দোকান লুট, মতিঝিলের ব্যাংক লুট ও রাস্তার গাছ কারা কেটেছিল তার চিত্রও ধারণ করতে পারতাম। বিশ্ববাসীকে সত্য ঘটনা জানাতে পারতাম। পারতাম তথ্য সন্ত্রাসের মূখোশ উন্মোচন করে দিতে।
৫ মে’র দিবাগত শেষ রাতেই বহু কষ্ট করে আমরা বাসায় ফিরে আসতে সম হই। সকালে টিভিতে জানতে পারলাম শাপলা চত্বরের ঐ কয়েক ল মানুষের সমাবেশে রাত আড়াইটায় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যেই বিনা রক্তপাতে তাদেরকে ঢাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খরবটা দেখে মনটা আনচান করে উঠল। কারণ মিডিয়ার চরিত্র নিজের চোখে দেখে আসলাম। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানার জন্য টিভি চ্যানেল ঘুরাতে লাগলাম। কোথাও দিগন্ত ও ইসলামিক চ্যানেল পেলাম না। টিভির পর্দায় লেখা দেখলাম সরকার সেগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। তাই চারিদিক থেকে খোঁজ খবর নিলাম। অবশেষে কিছু সামাজিক মিডিয়া, বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা ইত্যাদি থেকে জানলাম শাপলা চত্বরের ঐ অপারেশনে অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে। যখন তারা কেউ কেউ ২৫/৩০ কিঃ মিঃ দূর থেকে পায়ে হেঁটে আসার কান্তিতে, কেউ কেউ সারাদিন সেøাগান দেবার কান্তিতে, কেউ কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকার কান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ সেই গভীর রজনীতে আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিলেন। কেউবা আবার নামাজে দন্ডায়মান ছিলেন। রাত আড়াইটার ঐ অভিযানের সময় সরকার দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে, ঐ এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন কওে দিয়ে অপারেশন ফাস আউটের নতুন ইতিহাস সৃষ্ঠি করেছে।
বিষয়: রাজনীতি
১৮৩৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন